একটি সুষ্ঠু ডাকসু নির্বাচনের প্রতীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার
আবদুল মান্নান ১০ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০
সব ঠিকঠাক থাকলে এক দিন পর ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক হল ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত ছাত্রসংসদ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্লামেন্ট হিসেবে কাজ করে। নির্বাচনটি দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংসদে নির্বাচিত হলে তা অত্যন্ত সম্মানের বলে বিবেচিত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সিদ্ধান্ত হয় বিলেতের অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে তা হবে আবাসিক হলকেন্দ্রিক। অনেকে ভ্রান্তভাবে মনে করেন অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ নামের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আসলে তা কিন্তু নয়। অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ দুটি শহরের নাম। এখানে আছে বেশ কিছু কলেজ। এই কলেজগুলোর সমন্বয়ে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটাও তেমন ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত কিছু কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যায়ে পড়ানো হতো। এমন ব্যবস্থা ভারতে এখনো চালু আছে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ের লেখাপড়ার সুযোগ নেই। পড়তে হয় অধিভুক্ত কলেজে। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে অধ্যয়ন করা যায়। কেউ যদি বলে সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে, তা হলে তার কাছে জানতে চাইতে হবে কোন কলেজে। অনেকটা বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে তিনটি আবাসিক হল নিয়ে—মুসলিম হল, জগন্নাথ হল ও ঢাকা হল। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচিত হতো পালাক্রমে, আবাসিক হল থেকে নির্বাচিত ডাকসু সদস্যদের মধ্য থেকে। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত এ ব্যবস্থা চালু ছিল। এ ব্যবস্থায় সর্বশেষ ভিপি ছিলেন উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের অন্যতম নায়ক তোফায়েল আহমেদ। আর সরাসরি ভোটে ১৯৭২ সালে প্রথম ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আর সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান।

শুরু থেকে ডাকসু পরিচিত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন হিসেবে। এই ইউনিয়ন মূলত ছিল আবাসিক হল ইউনিয়ন আর শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় আবাসিক হলকে কেন্দ্র করে। ভর্তি থেকে শুরু করে পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন সব কিছু। বিভাগে কোনো শিক্ষার্থীর কোনো নথি সংরক্ষিত থাকে না। অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজে অথবা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন একজন শিক্ষার্থী পরিচিত হয় তার কলেজ দ্বারা, বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিচিত হয় তাদের হল দ্বারা। কিছু ছাত্রসংগঠন অনুষ্ঠিতব্য ডাকসু নির্বাচন একাডেমিক ভবনে অনুষ্ঠিত করার দাবি তুলেছিল। তেমনটি করা হলে তা একটি চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্ম দিত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রদের ইউনিয়ন সৃষ্টির পেছনে উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের সাংস্কৃৃতিক ও বিদ্যায়তনিক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করা। ১৯২৪ সালে প্রথম কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ গঠিত হয়, যার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জে এন সেনগুপ্ত। ভিপির কোনো পদ ছিল না। পদাধিকারবলে সভাপতি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পি জে হারটগ। ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনেকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৯৪৫ সালে ভিপি পদটি সৃষ্টি করা হয় এবং এই গঠনতন্ত্র অনুসারে প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন আহমদুল কবির, আর সাধারণ সম্পাদক সুধীর দত্ত। অন্যান্য দেশের ছাত্রসংসদ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে দেশ ও জনগণের স্বার্থে অনেকবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যা এ দেশের জন্ম ও স্বাধীনতার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ১৯৪৮ সালে ঢাকা এসে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন, তখন এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই প্রথমে তার প্রতিবাদ করেন। এ সময় ডাকসুর ভিপি ছিলেন অরবিন্দ বোস, আর সাধারণ সম্পাদক গোলাম আযম (পরবর্তীকালে জামায়াতের আমির ও একাত্তর সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত)। কথা ছিল জিন্নাহকে ডাকসুর পক্ষ থেকে তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হবে এবং তা দেবেন অরবিন্দ বোস। কিন্তু পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে যখনই বাঙালিরা তাদের দাবিদাওয়ার জন্য কোনো আন্দোলন করেছে, তখনই সেখানে পাকিস্তান সরকার ভারত ও হিন্দুদের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। সিদ্ধান্ত হলো হিন্দু ভিপির পরিবর্তে মুসলমান সাধারণ সম্পাদক গোলাম আযম স্মারকলিপিটি জিন্নাহকে হস্তান্তর করবেন। ভাষা আন্দোলনে এই হচ্ছে গোলাম আযমের ভূমিকা।
ডাকসুর সোনালি যুগ ছিল ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত করা, ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জিয়া আর এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও ডাকসু অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। ডাকসুর সর্বশেষ ভিপি ও জিএস ছিলেন ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবীর খোকন। এক বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে তাঁরা টানা আট বছর সংসদকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন। প্রতিবছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেই নির্বাচন তাঁরা নানা অজুহাতে করতে দেননি, আর ক্যাম্পাসের পরিবেশ নষ্ট করেছেন। অথচ ১৯৬৭ সালে তোফায়েল আহমেদ ও নাজিম কামরান চৌধুরী (এসএসএফ) আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের মাঝপথে ১৯৬৮ সালে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং তাঁরা আবারও ভিপি-জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। দেশের এক ক্রান্তিকালে নেতৃত্ব পরিবর্তন করাটা ঠিক হবে না সেই চিন্তা থেকেই তাঁদের আবার নির্বাচিত করা হয়। ১৯৭০ সালে ডাকসুতে ভিপি-জিএস হিসেবে আসেন আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন (দুজনই ছাত্রলীগ)। একসময় ডাকসু আর হল ইউনিয়নে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন, যেই দলেরই হোন না কেন, তাঁরা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র, সবাই বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া। তাঁদের সবারই নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্যতা ছিল। পরবর্তী সময় এই সংস্কৃতির পরিবর্তন হওয়া শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সংস্কৃতির পরিবর্তন শুরু হয়েছে ষাটের দশকের মাঝামাঝি, যখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান, যিনি আইয়ুব খানের একজন বশংবদ চাটুকার ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সৃষ্টি করেন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন বা এনএসএফ নামক একটি পেটোয়া বাহিনী। তাদের যাত্রা শুরু হয় অর্থনীতি বিভাগের প্রথিতযশা শিক্ষক অধ্যাপক আবু মাহমুদের মাথা ফাটিয়ে। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যে অশান্ত হওয়া শুরু হয়েছে, তা পরবর্তী সময় বহু বছর চলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদগুলো শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব উপহার দিয়েছে তা নয়, সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও অনেক মেধাবী নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। ডাকসু বা হল ইউনিয়ন ছিল মেধা চর্চার জায়গা। মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, মাহফুজা খানম, খোন্দকার মোশাররফ হোসেন (ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত মুহসীন হলের প্রথম ভিপি, বর্তমানে বিএনপি নেতা), সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, মাহবুবউল্লাহ, শাহদাৎ হোসেন, কামালউদ্দিন (ভিপি, মুহসীন হল, ছাত্রলীগ, পরবর্তী সময় ফরেন সার্ভিস)। একসময় তা জায়গা করে দিয়েছে টাকা আর পেশিশক্তিকে। এই বলয় থেকে বের হতে না পারলে ডাকসুর বা হল ইউনিয়নের যতই নির্বাচন হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদগুলোর হৃতগৌরব ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। একটি নির্বাচন হয়ে গেলে তখন নির্বাচিত সদস্যরা কোনো দলের থাকেন না। তাঁদের দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর একাডেমিক স্বার্থ রক্ষা করা আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ক্যাম্পাসের পরিবেশ রক্ষা করতে সহায়তা করা। কোনো অজুহাতে যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয় এক ঘণ্টার জন্যও অনির্ধারিতভাবে বন্ধ থাকে, তা হলে তা জাতির জন্য ক্ষতির কারণ হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা। সহিত্যিক আহমদ ছফার মতে, একটি বিশ্ববিদ্যালয় এক ঘণ্টার জন্যও যদি অনির্ধারিতভাবে বন্ধ থাকে তাহলে দেশ থমকে দাঁড়ায়। কিছু ছাত্রসংগঠনের অভ্যাস হয়ে গেছে নানা ঠুনকো অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেওয়ার। এটি করলে ক্ষতি কার তা তাদের চিন্তা করতে হবে। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এক দিনের জন্যও অনির্ধারিতভাবে বন্ধ হয়নি। পুলিশের টিয়ার গ্যাস উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে গেছে, পরীক্ষা দিয়েছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে সব বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রেখেছিলেন।
অনুষ্ঠিতব্য ডাকসু নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তাঁরা প্রত্যাশা করেন এই নির্বাচন খুলে দেবে ক্যাম্পাসে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সব জানালা। যাঁরা নিজেদের মেধাবী শিক্ষার্থী বলে দাবি করেন তাঁরা প্রায়ই বলে থাকেন, তাঁরা রাজনীতিকে ঘৃণা করেন। এটি মোটেও সুস্থ চিন্তা নয়। মেধাবীরা যদি রাজনীতিতে না আসেন তাহলে রাজনীতি চলে যাবে কালো টাকা আর পেশিশক্তির হাতে, যা দেশের জন্য কখনো মঙ্গল হতে পারে না। শুনেছি অনুষ্ঠিতব্য ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে যাতে হতে পারে তার সব আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শেষ করে এনেছে। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব এককভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নয়। এই দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের, যার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছাত্রসংগঠনগুলো। আগামী দিনের দেশের গণতন্ত্র আরো শক্তিশালী হবে কি না সেই প্রশ্নের কিছু জবাব তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে। ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হোক—সেই প্রত্যাশা রইল।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক