কালান্তরের কড়চা নির্বাচনজয়ী আওয়ামী লীগের সামনে আরো চ্যালেঞ্জ
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ১২ মার্চ, ২০১৯
ঢাকার এক তরুণ কলামিস্ট বন্ধু ৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে দুই হাতে আওয়ামী মহাজোটের পক্ষে কলম চালিয়েছেন। সুতীক্ষ তর্কের তরবারি দিয়ে প্রতিপক্ষের সব বাক্যজাল ছিন্ন করেছেন। ইদানীং দেখছি তাঁর লেখনীতে একটু ভাটা পড়েছে। দু-একটা লেখা যা বেরোচ্ছে তা জাতীয় রাজনীতি নিয়ে নয়। হয় আন্তর্জাতিক কোনো বিষয় অথবা দেশের কোনো সামাজিক বা বৈষয়িক সমস্যা।
পর পর কয়েক সপ্তাহ তাঁর অরাজনৈতিক লেখা পাঠ করে একটু বিস্মিত হলাম। হালে একদিন কৌতূহল আর দমন করতে না পেরে টেলিফোনে তাঁকে জিজ্ঞেস কলাম, আজকাল আপনার লেখা তেমন দেখছি না তো! তিনি বললেন, ‘লিখছি তো!’ বললাম এসব কী আর লেখা; ট্রাম্পের চালাকি কিংবা টেরেসা মের ব্রেক্সিট সংকট—এসব নিয়ে লেখা পড়ার জন্য বিলেতি কাগজ আছে। দেশের রাজনীতি, আওয়ামী লীগ কোন পথে যাচ্ছে, মহাজোট থাকার দরকার আছে কি নেই, ড. কামাল হোসেন এত বড় পরাজয়ের পরও মাঠ গরম রাখতে চাইছেন কেন—আপনার লেখায় পাঠক এসব খবর ও তার ভাষ্য জানতে চায়। আপনি হঠাৎ নেপথ্যে চলে গেলেন কেন?
কলামিস্ট বন্ধু একটা হাসি উপহার দিয়ে বললেন, ‘আপনি স্বীকার করবেন দেশে একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা আবার যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তাতে আমাদের মতো সাংবাদিক ও কলামিস্টদের দায়িত্ব ছিল এই দুর্যোগ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের পাশে থেকে তাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে দেশের চরম সর্বনাশ হয়ে যেত। সেই সর্বনাশ ঠেকানো গেছে। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়, আগামী পাঁচ বছরের জন্য নিরাপদ। এই অবস্থায় আমাদের দায়িত্ব শেষ। আওয়ামী লীগের দায়িত্ব শুরু। জনগণকে দেওয়া তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো পালন করবে, দেশকে সুশাসন দেবে, দুর্নীতি দূর করবে, রাজাকার-আলবদরদের সমাজজীবন থেকে উচ্ছেদ ঘটাবে, দেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত করবে—এসব এখন আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের চিন্তনীয় ও করণীয় বিষয়।’ তাঁকে বলেছি, অবশ্যই এসব সরকারের চিন্তনীয় ও করণীয় বিষয়। কিন্তু আমরা যারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক বলে মনে করি, তাদের কি সেই চেতনার সরকারকে পরামর্শ ও সহযোগিতা দেওয়া উচিত নয়? তিনি বললেন, ‘তারা কি আমাদের সাহায্য ও পরামর্শ চায়? আওয়ামী লীগ যখন দুর্যোগে থাকে তখন আমাদের সহযোগিতা ও পরামর্শ চায়। দুর্যোগ চলে গেলে আমাদের প্রয়োজন তাদের কাছে নেই। এ ব্যাপারে একটা প্রবাদ আছে, আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে হারলে আমাদের সকলকে নিয়ে হারে, জয়ী হলে একাই ক্ষমতায় যায়।’ আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছি, এটা অভিমানের সময় নয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হলেও স্বাধীনতার শত্রুপক্ষ এখনো রাজনৈতিক যুদ্ধে সম্পূর্ণ পরাজিত হয়নি। ড. কামাল হোসেন, ডা. জাফরুল্লাহ, মির্জা ফখরুল প্রমুখ এখনো ফোঁসফাঁস করছেন। তাঁরা সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। এই অবস্থায় দেশপ্রেমিক নাগরিক মাত্রেরই উচিত এই সরকারকে পরামর্শ, সমর্থন ও সর্বপ্রকার সহযোগিতা দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সঠিক পথ দেখানো।
তরুণ কলামিস্ট আমার কথায় সায় দেননি। বলেছেন, “আওয়ামী লীগের একজন বুদ্ধিজীবী ও সমর্থক ড. আনিসুজ্জামান বহুকাল আগে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ আমাদের শুধু সমর্থন চায়, পরামর্শ চায় না।’ এই অবস্থায় গায়ে পড়ে পরামর্শ দিতে গিয়ে কি হাস্যাস্পদ হব?” তরুণ কলামিস্টের এই উত্তরটা আওয়ামী লীগের তরুণ ও প্রবীণ অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর মধ্যেও দেখেছি। এই ভীতি, সংকোচ ও অভিমানের ভাবটা আওয়ামী লীগের একশ্রেণির নবীন ও প্রবীণ বুদ্ধিজীবী এবং শুভাকাঙ্ক্ষীর মধ্যে বিরাজ করতে দেওয়া উচিত নয়।
আওয়ামী লীগের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ওপেন ডিবেট প্রয়োজন, গবেষণা প্রয়োজন, তরুণ থেকে তরুণতম প্রজন্মের উপযোগী আওয়ামী লীগের রূপরেখা সম্পর্কে নেতৃত্বের চিন্তাভাবনা করা উচিত, কর্মপন্থা গ্রহণ করা উচিত। নইলে বদ্ধ জলাশয়ে যেমন দূষণ ধরে, আওয়ামী লীগ রাজনীতিতেও তেমন দূষণ দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগই একমাত্র দল, যে দলটি গতিশীল এবং যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকেও পরিবর্তন করেছে। ফলে দলটি এখনো দেশের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দল। এই দলে এখনো কোনো পচন ধরেনি। স্খলন, পতন আছে, তা সব দলেই আছে। এর নেতৃত্বেও কোনো শূন্যতা দেখা দেয়নি। এই সময়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কোনো নেতা নেই। তাঁর নেতৃত্বের বিকল্পও নেই।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক গতিশীলতা ও পরিবর্তনশীলতা বিস্ময়কর। জন্মের পর আওয়ামী লীগ ছিল একটি সাম্প্রদায়িক দল। ভাসানীর নেতৃত্ব তাকে একটি ধর্মান্ধ দলে পরিণত হতে দেয়নি। তাঁর আমলেই আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক দলের খোলস ফেলে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক দলে রূপান্তরিত হয়। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে দলটি সেন্ট্রাল লেফট থেকে সেন্ট্রাল রাইটে চলে আসে।
আওয়ামী লীগের নীতি ও চরিত্রে আমূল পরিবর্তন আনেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে দলটি সম্পূর্ণভাবে একটি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলে পরিণত হয়। ভারতের এক বাম সাংবাদিকের মতে, ‘মুজিবের সোশ্যাল ডেমোক্রেসি নেহরুর সোশ্যাল ডেমোক্রেসির চেয়েও প্রগতিশীল ছিল। মুজিব প্রকাশ্যেই সমাজতন্ত্রকে তাঁর দল ও রাষ্ট্রের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জাতীয়তাবাদ ছিল অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ।’
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু হয় সত্তরের দশকে। এরপর বিশ্বপরিস্থিতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপর্যয় এবং চীনের ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি গ্রহণের ফলে ইউরোপ, এশিয়া, এমনকি আফ্রিকায়ও সোশ্যালিজম ও সোশ্যাল ডেমোক্রেসি ভয়ানক ধাক্কা খায়। আমেরিকা একমাত্র সুপার পাওয়ার হয়ে দাঁড়ায়। ক্যাপিটালিজম গ্লোবাল দানবের রূপ ধারণ করে।
এই বিশ্বায়নের স্রোত ও পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে এবং পুরনো ডগমা আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়ে বিশ্বের বহু সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র ও দল তাদের অস্তিত্বই টিকিয়ে রাখতে পারেনি। অনেকেই আবার বাম থেকে ডানে একটা উন্মত্ত লাফ দিয়েছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের অনেকে গেছেন আওয়ামী লীগে, কেউ গেছেন ড. কামাল হোসেনের গণফোরামে, কেউ কেউ চরম ডানপন্থী বিএনপিতে। এটা চরিত্রের বদল নয়, চরিত্রের স্খলন বা পতন।
এদিক থেকে আওয়ামী লীগের চরিত্রের স্খলন বা পতন হয়নি। যুগ-পরিবেশের প্রভাবে পরিবর্তন ঘটেছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব দলটিতে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের ভিত্তি অটুট রেখে তাকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল থেকে লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলে রূপান্তর ঘটিয়েছে। এই রূপান্তরের অনেক বিপজ্জনক দিক থাকলেও তা যুগের প্রয়োজন মিটিয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের অনেকেই জাতিকে একটি দর্শন উপহার দেন। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট দিয়েছিলেন নিউ ডিল এবং প্রেসিডেন্ট কেনেডি দিয়েছিলেন নিউ ফ্রন্টিয়ার।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগই জাতির, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সামনে নতুন নতুন স্বপ্ন-দর্শন তুলে ধরে। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের দর্শন ছিল সোনার বাংলা। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের দর্শন ডিজিটাল বাংলা। এবারের নির্বাচনের সময় দর্শন ছিল ‘মধ্যম আয়ের উন্নত বাংলা গড়া’। মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম তাতে বিপুলভাবে সাড়া দিয়েছে। বিরোধী দলগুলো গণতন্ত্র স্লোগানের পুরনো কাঁথা সেলাই করে লাভবান হয়নি।
কিন্তু নির্বাচনে জয়ই কোনো রাজনৈতিক দলের প্রকৃত সাফল্য নয়। প্রকৃত সাফল্য রয়েছে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্যে। দেশ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে; কিন্তু দুর্নীতির রাক্ষসকে বধ করা সম্ভব হয়নি। সুশাসন এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অপশাসন ও ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। তরুণ প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা যায়নি। এবারে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারকে এ ক্ষেত্রে কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণ, সততার সঙ্গে তার বাস্তবায়ন দ্বারা প্রমাণ করতে হবে দেশ শাসনের জন্য জনগণ তাদের পঞ্চমবারেও ম্যান্ডেট দিয়ে কোনো ভুল করেনি এবং বর্তমান বাংলাদেশে হাসিনা নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই।
লন্ডন, সোমবার, ১১ মার্চ ২০১৯