জীবনের নিরাপত্তার অধিকার
এবারের জাতীয় আইনি সহায়তা দিবস ছিল ২৮ এপ্রিল। এই দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদালতে মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমানোর পাশাপাশি খুন-ধর্ষণ-অগ্নিসন্ত্রাসসহ গুরুতর ফৌজদারি অপরাধগুলোর দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে বলেছেন। সমাজের সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কাজ করার নির্দেশনা দিয়ে সরকারের আইনি সহায়তাকে তৃণমূলে ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই প্রতিটি মানুষ ন্যায়বিচার পাক। সেই ব্যবস্থাটা যাতে নেওয়া হয়, সেটা আপনারা নেবেন। আমরা চাই না আমরা যেমন বিচার না পেয়ে কেঁদেছি, আর কাউকে যেন এভাবে না কাঁদতে হয়। সকলে যেন ন্যায়বিচার পায়।’
প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘদিনব্যাপী বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও বিএনপি-জামায়াতের অন্যায় অত্যাচারের কথা স্পষ্টত ব্যক্ত হয়েছে। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন তাঁকে টার্গেট করে যে ১৯টির অধিক হামলা ও হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল—তার অধিকাংশের বিচার না হওয়ার ঘটনাও। কেবল ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার সমাপ্ত হলেও ২০০৪ সালের ওই ঘটনার বিচার পেতেও শেখ হাসিনাসহ সকল ভিকটিমকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।
এভাবে নিজের জীবন ও দলের নেতাকর্মীদের মামলার দীর্ঘসূত্রতার অভিজ্ঞতা শাসক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে অনেক বেশি মানবিক করে তুলেছে। তিনি অনুভব করেছেন কারাগারে এখনো অনেকেই আছেন, কি কারণে যে জেলে তারা জানেন না। তাদের অপরাধের ধরনও পরিষ্কার নয়। কি করে আইনগত সহায়তা পাবেন সেটাও জানেন না। এই বিষয়গুলো দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রী আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে খুন, অগ্নিসন্ত্রাস, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা, ধর্ষণ, নানা ধরনের সামাজিক অনাচারের বিচার যেন খুব দ্রুত হয় এবং কঠোর শাস্তি দেওয়া যায় তাও নিশ্চিত করতে বলেছেন। অর্থাত্ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি মানবাধিকার রক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
আমরা সকলে জানি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ‘মানবাধিকার’ রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূল লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত। এ জন্য মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং নিশ্চিতকরণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার যথাযথভাবে নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ জাতীয় সংস্থাগুলো কাজ করতে বাধ্য। এখানে ‘মানবাধিকার’ বলতে সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ঘোষিত ‘মৌলিক অধিকার’ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলে ঘোষিত মানবাধিকার, যা প্রচলিত আইন দ্বারা স্বীকৃত তাকে বুঝানো হয়েছে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত ২২টি মৌলিক অধিকারের মধ্যে কয়েকটি হলো—আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকাররক্ষণ, গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ, বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ, চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার বলবত্করণ, শৃঙ্খলামূলক আইনের ক্ষেত্রে অধিকারের পরিবর্তন, দায়মুক্তি-বিধানের ক্ষমতা প্রভৃতি।
বাংলাদেশের নাগরিকদের ২২টি মৌলিক অধিকার থাকলেও কয়েকটি শর্তবন্দি অধিকার রয়েছে। এর মধ্যে ‘শৃঙ্খলামূলক আইনের ক্ষেত্রে অধিকারের পরিবর্তন’ গুরুত্বপূর্ণ। কোনো শৃঙ্খলা-বাহিনীর সদস্য-সম্পর্কিত কোনো শৃঙ্খলামূলক আইনের যে কোনো বিধান উক্ত সদস্যদের যথাযথ কর্তব্য পালন বা উক্ত বাহিনীতে শৃঙ্খলারক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধান বলে অনুরূপ বিধানের ক্ষেত্রে এই ভাগের কোনো কিছুই প্রযোজ্য হবে না। অর্থাত্ শৃঙ্খলাবাহিনী মৌলিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে অপ্রযোজ্য। তবে ‘দায়মুক্তি-বিধানের ক্ষমতা’ প্রয়োগে তারা ভিন্নতর অধিকার ভোগ করে থাকে।
মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে সংবিধানের এই ধারাসমূহের বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না গিয়েও আমরা বলতে পারি, হাইকোর্ট বিভাগ একজন ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ্ন হলে তার প্রতিবিধানে যথাযথ আদেশ কিংবা নির্দেশ দিতে পারেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও সেই আদেশ মানতে বাধ্য। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড মেরে তত্কালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম দৃষ্টান্ত। একই বছর প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা লেখকের চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের ওপর নিষ্ঠুরতম আঘাত হিসেবে গণ্য হয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িত জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা বিচারের সম্মুখীন হয়েছে। আর অপরাধীদের গ্রেফতার করার পুরো কৃতিত্ব ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। তাহলে মানবাধিকার রক্ষা কিংবা পুনরুদ্ধারে গ্রেনেড হামলা কিংবা বোমাবাজদের বিচারের সম্মুখীন করা এবং দায়ীদের শাস্তি বিধান যেমন আদালতের কর্তব্য তেমনি সন্ত্রাসী-অপরাধীদের ধরে বিচারে সমর্পণ করা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্ব।
গত ১০ বছরে শেখ হাসিনা সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৪ সালের মে মাসে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলায় র্যাবের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার ও বিচারের ঘটনাটি উল্লেখ করা হয় বারংবার। কারণ এতে মানুষ আজ ন্যায়বিচারের সুবিধা পাচ্ছে- এটা স্পষ্ট। অবশ্যই সরকারকে সবসময় এটা নিশ্চিত করতে হবে। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী তিন মাস বিএনপি-জামায়াত সমর্থকরা পেট্রোল বোমা ছুড়ে হরতাল ও অবরোধ কার্যকর করতে চেয়েছিল; নির্বাচনের আগে ও পরে হিন্দু ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বাড়ি ও দোকানপাটে হামলাও চালিয়েছিল। এসব ঘটনায় দোষীদের এখনো বিচার সম্পন্ন হয়নি। অনুরূপভাবে ২০০১ সালের নির্বাচন-উত্তর হিন্দু-খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্মম নির্যাতন করেছিল জামায়াত-বিএনপি; হত্যা-ধর্ষণে মেতে উঠেছিল তারা; কিন্তু ওই ‘গণতন্ত্রের শত্রু’, ‘মানবতার শত্রু’ ও ‘সভ্যতার শত্রু’দের বর্তমান সরকার এখনো কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেনি।
একবিংশ শতাব্দীতে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থানে বিশ্বের বুকে নতুন এক সন্ত্রাসের আবির্ভাব ঘটে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার হলি আর্টিজানের হামলা ও হত্যাকাণ্ড আমাদের কাছে ভয়ংকর ছিল। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ ও শ্রীলঙ্কায় জঙ্গিবাদীদের উন্মত্ত আচরণ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে গোটা মানব বিশ্ব বিব্রত এবং ভীতসন্ত্রস্ত। বিভিন্ন জাতিধর্ম গোষ্ঠীর সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি আর সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য বহির্বিশ্বে সুনামের অধিকারী বাংলাদেশেও হঠাত্ করে জঙ্গিবাদী সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। কিন্তু সেই জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। নাশকতা ও সহিংসতা গণতন্ত্রকামী মানুষকে আকৃষ্ট করে না। বরং যারা নাশকতা ও সহিংসতা করে বা এর পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাদের প্রতি ক্রমাগত ঘৃণাই প্রকাশ করে জনগণ। ক্ষমতায় যে দলটিই যাবে তার কাছে জনগণের প্রত্যাশা থাকে সুখী, সমৃদ্ধ এবং একইসঙ্গে জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ। আসলে জঙ্গি চারণভূমিতে পরিণত হোক বাংলাদেশ—নিশ্চয় এই চাওয়া আমাদের নয়। পাঁচশ জায়গায় একসঙ্গে বোমা হামলা, আদালতে বোমা নিক্ষেপ, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, কিবরিয়া হত্যা, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা, হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি, বাংলা ভাই ইত্যাদি বাংলার মানুষ কখনো ভুলবে না। এদেশ হত্যার অভয়ারণ্য হোক এটা আমরা কেউ চাই না। আর এই ঘটনাগুলোর পিছনে যারা ছিল তাদের ধরে বিচারের সম্মুখীন করার কৃতিত্ব বর্তমান সরকারের। যা ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত উদাহরণ তা থেকে রক্ষা করে সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অবয়ব হচ্ছে সময়োপযোগী, আধুনিক, জনবান্ধব ও সেবাধর্মী আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী ও বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা। বিচারক ও আইন-শৃঙ্খলা সদস্যদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনসাধারণকে সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানসহ আইনগত সহায়তা দিতে বিশেষভাবে তত্পর থাকতে হবে। অপরাধীদের গ্রেফতার এবং নিরপেক্ষভাবে তদন্ত পরিচালনার ওপরই আইনের শাসন ‘অনেকাংশে’ নির্ভর করে। জীবনের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিধানের অধিকার রয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের। কাউকে নৃশংস অত্যাচার ও খুন করা স্পষ্টত মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত পর্যায়। বর্তমানে এসব বিষয়ে সতর্ক রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৮ এপ্রিলের ভাষণ থেকে তাঁর সদিচ্ছার পরিচয় পেয়েছি আমরা।
ড. মিল্টন বিশ্বাস
লেখক :অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়