নারীর ক্ষমতায়ন ও দক্ষ নেতৃত্ব
ড. মিল্টন বিশ্বাস ১৪ মার্চ, ২০১৯

চলতি বছর (২০১৯) ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উপলক্ষে নারীর ক্ষমতায়ন ও দক্ষ নেতৃত্বের জন্য ‘লাইফটাইম কন্ট্রিবিউশন ফর উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৭ মার্চ জার্মানির বার্লিনে সিটি কিউব আইটিবি প্রাঙ্গণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান উইমেন (আইএসএডবিউ) এই পদক প্রদান করে। বলাবাহুল্য, নারীর ক্ষমতায়নে শেখ হাসিনার অসামান্য অবদান এবং দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে দক্ষ নেতৃত্বের কথা অনেক আগে থেকেই বিশ্ববাসী জানেন। তবে এই সম্মাননার গুরুত্ব রয়েছে। এই অ্যাওয়ার্ড অর্জনের মাধ্যমে তাঁর ‘আন্তর্জাতিক সম্মাননা’র সংখ্যা বেড়ে ৩৬টিতে দাঁড়িয়েছে। এর আগে তিনি নারীর ক্ষমতায়নে অবদানের জন্য ২০১৬ সালে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ড এবং ‘প্লানেট-৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ সম্মানে ভূষিত হন। বাংলাদেশে নারী শিক্ষা এবং উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে অসামান্য নেতৃত্বের জন্য প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল ‘গ্লোবাল উইমেন’স লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেছেন। আবার রাজনীতিতে নারী ও পুরুষের বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনের জন্য ২০১৫ সালে উইমেন ইন পার্লামেন্ট (ডব্লিউআইপি) এবং ইউনেস্কো তাঁকে ‘ডব্লিউআইপি গ্লোবাল ফোরাম অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। নারীদের শিক্ষার উন্নয়নে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ‘ট্রি অব পিস’ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই, স্বাস্থ্যখাতে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারী ও শিশু মৃত্যুহার কমিয়ে আনার জন্য দুইবার ২০১১ ও ২০১৩ সালে শেখ হাসিনা ‘সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত হন।
গত বছর (২০১৮) ‘গ্লোবাল সামিট অব উইমেন্স লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ পাওয়ার সময় সিডনিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘নারীদের সহযোগিতা ও তাদের অধিকার তুলে ধরতে আমাদের একটি নতুন জোট গঠন করতে হবে। লাখ লাখ নারীর স্বার্থে আমাদের অবশ্যই অভিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধ নিয়ে একত্রে কাজ করতে হবে।’ সেসময় তিনি পুরস্কারটি যারা নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করছেন বিশ্বের সেসব নারীকে উত্সর্গ করেন। তিনি সেদিন আরো বলেছিলেন, ‘কোনো মেয়ে ও নারী পিছিয়ে পড়ে থাকবে না।’ তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশের নারীরা এখন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন। নারীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁর সরকারের আমলে গত ১০ বছরে নারীর ক্ষমতায়নে এমন সব উল্লেখযোগ্য কাজ করা হয়েছে যা নারীর পিছিয়েপড়া পরিস্থিতিকে পাল্টে দিয়েছে।
উল্লেখ্য, নারীর ক্ষমতায়ন বলতে একজন নারীর স্বকীয়তা, নিজস্বতা সর্বোপরি স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিকাশকে বোঝানো হয়। নারী-পুরুষের মধ্যকার অসমতা ও বৈষম্য দূর করে নারীকে পুরুষের সমকক্ষে প্রতিষ্ঠিত করাই হলো নারীর ক্ষমতায়ন। এই ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত করার জন্য শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপসমূহ যৌক্তিক এবং অনন্য। যেমন- জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৫টি থেকে ৫০ টি করা, রাজনীতিতে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ইউনিয়ন কাউন্সিল ও উপজেলা পরিষদে এবং পৌরসভায় সংরক্ষিত নারীর আসন এক-তৃতীয়াংশে উন্নীতকরণ ও সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং পরিবারে নারীর সমতা বিধানের জন্য যৌতুক প্রতিরোধে ‘যৌতুক নিরোধ আইন- ২০১৭’ প্রণয়ন করা। এছাড়া পাসপোর্টসহ সকল ক্ষেত্রে পিতার সঙ্গে মাতার নাম লেখার রীতি বাস্তবায়ন, প্রসূতি মায়েদের জন্য ছয় মাসের ছুটি কার্যকর করা, দরিদ্র ও গর্ভবতী মায়েদের মাতৃকালীন ভাতা প্রদান, সরকারি কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ৪০টি মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার সেনসিটিভি বাজেট প্রদান; নারী বোর্ড ও জাতীয় মহিলা সংস্থা প্রতিষ্ঠা, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে ২০১১ সালে ‘জয়িতা ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ আইন-২০১৫ প্রণয়ন ছাড়াও নারীর ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রায় ১৫৪ কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়া বেকার এবং অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের জন্য বর্তমান সরকারের অধীনে আরো অনেক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সংবিধানে নারীর অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধারা সন্নিবেশ করা হয়েছে। ১৯ অনুচ্ছেদে বর্ণনা হয়েছে- ‘জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের ক্ষমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবে।’ এই সাংবিধানিক অধিকারকে স্মরণে রেখে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে বেশকিছু অঙ্গীকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, ২০২০ সাল নাগাদ উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষায় নারী-পুরুষ শিক্ষার্থীর অনুপাত বর্তমানের ৭০ থেকে ১০০ শতাংশে বৃদ্ধি করা হবে; প্রশাসন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে নারীর অধিক সংখ্যায় নিয়োগের নীতি আরও বৃদ্ধি করা হবে; নারী উদ্যোক্তাদের উত্সাহিত করতে তাদের জন্য আলাদা ব্যাংকিং সুবিধা, ঋণ সুবিধা, কারিগরি সুবিধা ও সুপারিশসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে ইত্যাদি।
আসলে নারীর ক্ষমতায়ন করতে হলে নারীকে ক্ষমতা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা এবং নারীদের শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। সমাজ ও অর্থনীতিতে নারীর অবদান যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে এবং তাদের উপর নির্যাতন করা প্রতিরোধ করতে হবে, তবেই নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত এই প্রতিশ্রুতিসমূহ পূরণ করার মধ্য দিয়ে এদেশ আরো বেশি অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হবে বলে আমরা মনে করি।
লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা