বন্যা মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ জরুরি
১২ জুলাই (২০১৯) গণভবনে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ ও কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতির কথা স্মরণে রেখে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় তার সরকারের সক্ষমতার কথা তুলে ধরে বলেছেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। আমরা অবহেলা করে রাষ্ট্র পরিচালনা করি না। আমরা মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে, মানুষের বিপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো, মানুষের কল্যাণে ও উন্নয়নে কাজ করা এই নীতি নিয়ে কাজ করি বলেই আজকে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম।’
প্রধানমন্ত্রীর কথার সূত্র ধরে আমরা লক্ষ করি ‘বাড়ছে পানি বাড়ছে ভয়’ শীর্ষক সংবাদে ১৩ জুলাই (২০১৯) দৈনিক আমাদের সময়ে লিখেছে, ১০ জেলার নদ-নদীর পানি বিপদসীমা ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে যাচ্ছে। কারণ নদ-নদীগুলোর ৬২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট রয়েছে; এর মধ্যে ২৬টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ভাঙন দেখা দিয়েছে মানিকগঞ্জ, জামালপুর ও লালমনিরহাটে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ১১ জুলাই ছিল ১২টি, ১২ তারিখে দেশের ১৪টি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব পয়েন্টে পানির উচ্চতা ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী কয়েকদিন ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে, তাতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। উল্লেখ্য, দ্রুত সময়ের মধ্যে লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার এবং নীলফামারী জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উজানে ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশে যমুনা নদীতে পানি আরও বাড়বে। পাশাপাশি উজানে গঙ্গার পানি বাড়ায় বালাদেশে পদ্মা অববাহিকায় বন্যা দেখা দিতে পারে।
সংবাদপত্র সূত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের কয়েক লাখ মানুষ এখন পানিবন্দি। টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে আষাঢ়ের শেষ সপ্তাহে দেশের ১০টি জেলার লাখ লাখ মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। গেল সপ্তাহের ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সময় এসেছে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। আরও কয়েকদিন সারাদেশে ভারী বর্ষণ হলে এসব এলাকার নদ-নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে এসব এলাকায় স্থায়ী বন্যার আশঙ্কাও সঙ্গত কারণে অমূলক নয়। তাই বর্তমান পরিস্থিতিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করতে হবে। বন্যার দুর্যোগ মোকাবিলা করার ত্বরিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
২
মনে রাখতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চিরচেনা বর্ষা আজ পাল্টে গেছে। এ কারণে বিরূপ পরিবেশে বর্ষা যেন আজ ম্রিয়মাণ। টানা বর্ষণে নগরজীবনে নেমে আসে জলাবদ্ধতার আতঙ্ক আর গ্রামবাসী বন্যার শঙ্কায় কিংবা ভাঙনের দুশ্চিন্তায় দিন পার করে। অতীতে আষাঢ়ের বৃষ্টি আসত নতুনত্ব নিয়ে। চৈত্র-বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের প্রখর তাপদাহ থেকে শীতলতা দিতে নিয়ে আসত শান্তির বরিষণ। হাজার বছর ধরে আষাঢ়ের বারিত হওয়ার রূপ বাংলার পরিচিত দৃশ্য ছিল। তুমুল বৃষ্টিধারা, নদীমাতৃক দেশের নদীর পূর্ণ যৌবন, নদ-নদীর ভাঙাগড়া সবই বাংলাদেশের মানুষের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। তবে আষাঢ়-শ্রাবণে মেঘ ও রৌদ্রের খেলা পাল্টে গেছে। গবেষকরা বলে থাকেন গত ৫০ বছর সময়কালে বৃষ্টিপাত বেড়েছে প্রায় গড়ে ২৫০ মিলিমিটার। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব হিসেবে গণ্য হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের আধিক্য, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন বর্ষায় মেঘ করা মানে যখন-তখন যেখানে-সেখানে বাজ পড়া।
গত একশ বছরের গড় তাপমাত্রা বিশ্লেষণে দেখা গেছে ০.৬০ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। একুশ শতকের শেষ পর্যায়ে এই তাপমাত্রা ২.৫ ডিগ্রি থেকে ৫.৬ ডিগ্রিতে উন্নীত হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, পৃথিবীর প্রায় ৪০ শতাংশ লোক বিপদের মধ্যে পতিত হবে। উপকূলীয় এলাকায় ক্ষতির পরিমাণ বেশি হবে। বিশেষ করে ঝুঁকির মধ্যে থাকবে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, অগ্রগামী ৫০ বছরে পানির উচ্চতা ৩ ফুট বাড়তে পারে এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। আনুমানিক ৩ কোটি লোক গৃহহীন হয়ে পড়বে এবং ১৭ শতাংশ জমি পানিতে বিলীন হতে পারে। ‘ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’র তথ্যমতে, ২০৩০ সালের পর নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে পানিস্বল্পতা দেখা দিতে পারে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ১০০ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, উষ্ণায়নের ৫টি দিক পরিলক্ষিত হয়। এগুলো হলো বন্যা, মরুকরণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঝড় এবং কৃষিতে অনিশ্চয়তা। এই দুর্যোগের ভেতর আছে ১২টি দেশ যার অন্যতম হলো বাংলাদেশ। ১৯৬৮ সালে স্টকহোম সম্মেলনের মূলমন্ত্র ছিল বিশ্ব পরিবেশের নিরাপত্তা এবং ৫ জুন আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবসের ঘোষণা। পরবর্তী সময়ে ১৯৯২ সালে রিওডি জেনিরোতে প্রথম ‘ধরিত্রী সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রায় ১৯০টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেয়। জরড় উবপষধৎধঃরড়হ ড়হ ঊহারৎড়হসবহঃ ধহফ উবাবষড়ঢ়সবহঃ-এ বনাঞ্চলসংক্রান্ত নীতিমালাসহ আরও বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৩ সালে ‘কানকুন সম্মেলন’ হলো। প্রায় সব সম্মেলনেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সতর্কতা প্রদান করা হয়েছে। ‘বন্যা’ সম্পর্কে নিতে বলা হয়েছে ‘ডেল্টা প্ল্যানে’র মতো ১০০ বছরের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। সাম্প্রতিক বন্যাদুর্গত মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে সরকারি উদ্যোগের পাশে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের তৎপর ও সহায়তার হাত প্রসারিত করতে হবে। জনগণের দুর্ভোগের সময় জনপ্রতিনিধিরা পাশে থাকবে এটাই প্রত্যাশিত। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো জরুরি প্রয়োজন। প্রকৃতির কাছ থেকে যত বড় আঘাতই আসুক না কেন, সম্মিলিতভাবে তা মোকাবিলা করতে হবে। বন্যা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত পুনর্বাসনকেন্দ্র তৈরি করা জরুরি।
৩
‘বন্যা’ এখন কড়া নাড়ছে দুয়ারে। লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং নীলফামারী ও পাহাড়ি জেলাগুলোর নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে তীর উপচে পানি ঢুকে গেছে লোকালয়ে। কৃষিজমি তলিয়ে যাওয়াসহ ক্ষেতখামার, পুকুর, ঘরবাড়িও তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। কোথাও বা পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে। এ দেশের বাস্তবতা হলো ঝড়-বৃষ্টি কিংবা বন্যার কারণে বিপর্যয় হলে উপদ্রুত এলাকায় খাদ্য ও সুপেয় পানির অভাবে দুর্গত মানুষকে আরও দুর্ভোগে পড়তে হয়। ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় এখন এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে হবে। দুর্গত মানুষকে এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। ত্রাণ তৎপরতার জন্য সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুসারে অবিলম্বে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে দুর্গত মানুষের পাশে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়াতে হবে। কারণ বন্যা-পরবর্তী উপদ্রুত অঞ্চলে সংক্রামক রোগের প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করে থাকে। বন্যা মোকাবিলায় সংক্রামকসহ নানাবিধ জীবননাশক রোগবালাইয়ের আক্রমণকে নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। বন্যা-পরবর্তী নাজুক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ যে কোনো মুহূর্তে মানুষের জীবনকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। বন্যার পর পানি পান করার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ভালো করে পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই কাঁচা পানি বা সিদ্ধ না করে পানি পান করা যাবে না। ফলমূল, শাকসবজি খাওয়ার ক্ষেত্রেও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা ব্যাপক বন্যায় শাকসবজি, ফলমূল সহজেই নানাবিধ জীবাণু অথবা সংক্রামক ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে এবং হওয়াটাই এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক। শাকসবজি বা ফলমূল খাওয়ার আগে ফুটন্ত পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে সিদ্ধ পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখতে হবে। এর পর ফলের ক্ষেত্রে ভালো করে চামড়া ছেড়ে তা খেতে হবে। শাকসবজি পুরোপুরি সিদ্ধ করে খাওয়া ভালো।
অন্যদিকে ভারতের বেশকিছু স্থানে বন্যায় মৃতের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতির অবনতি আমাদেরও উৎকণ্ঠিত করে। কারণ একই নদীর প্রবাহ রয়েছে উভয় দেশে। সীমান্তবর্তী প্রদেশের নদীগুলোতে পানির চাপ অব্যাহতভাবে বাড়ায় নতুনভাবে সতর্কবার্তা জারি করেছে রাজ্যগুলোর সরকার। চলছে উদ্ধার তৎপরতা। কয়েকটি জায়গায় খোলা হয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলার অস্থায়ী ক্যাম্প। আমাদের মতোই কয়েকদিন ধরে চলা বিরামহীন বৃষ্টির কারণে সেখানে বন্যা দেখা দিয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকা বন্যাকবলিত হলে স্বাভাবিকভাবে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশ প্লাবিত হয়। বন্যা মোকাবিলায় এজন্য উভয় দেশের যৌথ উদ্যোগ দরকার। আশা করি নিজস্ব উদ্যোগের পাশাপাশি বর্তমান সরকার সেদিকেও মনোযোগ দেবে।
ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়