Blue economy ও সমুদ্র নিরাপত্তা প্রসঙ্গ
‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’-এ ব্লু ইকোনমি বিকাশের বিষয়টি সর্বোচ্চ প্রাধান্য পেয়েছে। সুনীল অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা এবং এর জন্য প্রস্তাবিত কৌশলগুলোও ওই প্ল্যানে গ্রহণ করা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের জাতীয় আয়ের বেশির ভাগ আসে সমুদ্রনির্ভর কর্মযজ্ঞ থেকে। যেমন—চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কিছু দেশ ২০০ থেকে ৩০০ বছর আগেই সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করেছে, যার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির বেশির ভাগই হচ্ছে সমুদ্রনির্ভর। অস্ট্রেলিয়াও সমুদ্রসম্পদ থেকে আয় করছে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৫ সালে এ খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সে দেশের সরকার। এ ছাড়া বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড হচ্ছে সমুদ্র ঘিরে। বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ ও উদ্ভিদ। ৩০ শতাংশ জ্বালানি তেল ও গ্যাস আসছে সাগর থেকেই। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের মালিকানায় রয়েছে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। বিশাল এ জলসীমাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে প্রতিবছরই হাজার হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব। বাংলাদেশের স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ বিদ্যমান তার সঙ্গে তুলনা করে বলা যায়, এই সম্পদের প্রায় সমপরিমাণ (৮১ শতাংশ) সম্পদ সমুদ্র তলদেশে আছে। সাগরে ৫০০ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী বাস করে। এগুলোর মধ্যে শামুক, শ্যালফিস, কাঁকড়া, হাঙর, অক্টোপাস এবং নানা জাতির মাছ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রাণিসম্পদ ছাড়াও ১৩টি জায়গায় আছে মূল্যবান বালু, ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম। এগুলোতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমেনাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইট। এসব সম্পদ অতি মূল্যবান। অনেকে বলে, এগুলো সোনার চেয়েও মূল্যবান। তা ছাড়া সিমেন্ট বানানোর উপযোগী প্রচুর ক্লে রয়েছে বাংলাদেশের সমুদ্র তলদেশে। এ সমুদ্র এলাকায় বছরে ৮০ লাখ টন মাছ ধরার সুযোগ আছে।
২০১২ সালের ১৪ মার্চ বাংলাদেশ-মিয়ানমার মামলায় আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের (পিসিএ) রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় এক লাখ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি জলসীমা পেয়েছে। সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের জন্য ১২ নটিক্যাল মাইল রাষ্ট্রাধীন সমুদ্র এলাকা, ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল সীমানা এবং মহীসোপানে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্র সীমানার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের সামুদ্রিক সীমানা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ দেশ সমৃদ্ধির সোপানে উঠতে পারবে বলে সবাই মনে করে। এ জন্য মামলার নিষ্পত্তির মাধ্যমে যেসব এলাকায় আমাদের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, সেসব এলাকায় সব ধরনের জৈব ও খনিজ সামুদ্রিক সম্পদ এবং মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও আহরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের ব্যবস্থা করা এবং এই সমুদ্র অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে গৃহীত সব উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে গত এক দশকে আওয়ামী লীগ সরকার। তবে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সমুদ্রভিত্তিক গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য দরকার জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সমুদ্র উপকূল বনায়নের কর্মসূচিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
আসলে বাংলাদেশের সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা ও দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যবস্থা গ্রহণ সব সময়ই জরুরি। ক্রমাগত সম্পদ আহরণের ফলে বিশ্বের স্থলভাগের সম্পদ আজ সীমিত। তাই সারা বিশ্ব এখন নতুন সম্পদের খোঁজে রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ব্লু ইকোনমির মাধ্যমে সমুদ্রসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রতিবছর দেশের বন্দরের ব্যবহার ১২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জরুরি হয়ে উঠেছে নতুন একটি বন্দরের। তা ছাড়া বর্তমানে দুটি বন্দরে যে আকারের জাহাজ আসতে পারে, তার চেয়ে বৃহত্তর দৈর্ঘ্য ও বেশি গভীরতার জাহাজ সরাসরি পায়রা বন্দরের জেটিতে আসতে পারলে সামগ্রিকভাবে লাভবান হতে পারবে দেশের শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনীতি।
বর্তমানে বাংলাদেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন প্রায় এক লাখ ১১ হাজার ৬৩২ বর্গকিলোমিটার। আগেই লিখেছি, এই সমুদ্রসীমা অগাধ প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার, যা আমাদের দেশের বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার সম্পূর্ণ চাহিদা মেটাতে সক্ষম। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন এই সম্পদের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও ব্যবহার। বর্তমান সরকার এ জন্যই কাজ করছে। কারণ বঙ্গোপসাগরের সম্পদরাজির যথাযথ সংরক্ষণ আমাদের নিজেদের উন্নয়নের স্বার্থেই প্রয়োজন। সমুদ্রসম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে ১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। সরকারের ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এই সমুদ্রসম্পদ আহরণের দায়িত্বে রয়েছে। এই মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ভেতর সমন্বয় সাধন করা জরুরি। সমুদ্রসম্পদ ব্যবহার করে বাংলাদেশ একাধারে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি নিজেদের দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।
লেখক : মিল্টন বিশ্বাস অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com