সুকুমারবৃত্তি চর্চা জরুরি
আসলে পাশবিকতার প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দরকার শিশুকাল থেকে সুকুমারবৃত্তির চর্চা করা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নয় মাদরাসা, মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা ও হাটবাজারের নিরক্ষর মানুষকে সৎ প্রবৃত্তির প্রতি অনুরাগী করে তুলতে হবে, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর জন্য প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে, অপরাধ করলে তার শাস্তি দ্রুত কার্যকর করার দৃষ্টান্তও তুলে ধরতে হবে। তবে শেষ পর্যন্ত সবাই স্বীকার করেন যে সমাজের বিবেক জাগ্রত করা দরকার। এই সমাজের বিবেক জাগ্রত করার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। যে তরুণসমাজ আজ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে তাদের তারুণ্যের শক্তিকে ভালো কাজে লাগানোর জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর জোর দিতে হবে।
সুকুমারবৃত্তি চর্চার প্রধান ক্ষেত্র হলো পারিবারিক জীবন। নিজের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে আমাদের। তাদের মনের কথাটা শোনার চেষ্টা করা দরকার। তাদের সঙ্গ দিতে হবে। উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা যেন মা-বাবার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারে সে সুযোগটা তাদের দেওয়া খুব প্রয়োজন। তাহলেই সুকুমারবৃত্তি চর্চার দ্বার উদ্ঘাটন সম্ভব। সন্তানরা কিভাবে চলছে, কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে—সেদিকে ‘বিশেষভাবে দৃষ্টি’ দেওয়ার জন্য অভিভাবকদের মনোযোগী হতে হবে। সামাজিক অবক্ষয় রোধে পারিবারিক ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রত্যেকটি মানুষকে সচেতনতার পথ পাড়ি দিতে হবে। এ ছাড়া শিশুর আচরণ পরিবর্তন হচ্ছে কি না তা খেয়াল করতে হবে। তার আচরণ থেকেও অনেক সময় অনেক কিছু বোঝা সম্ভব। শিশুর কথা শুনতে হবে ও তাকে বিশ্বাস করতে হবে। পরিবারের মমতা, ভালোবাসা, সুখ-শান্তি, সৌহার্দ্য, মা-বাবার মধ্যে সুসম্পর্ক, পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সম্প্রীতি সন্তানের মানসিক বিকাশ সুগঠিত করে। অর্থাৎ শিশুর বেড়ে ওঠা ও মানস গঠনে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শুধু শিশু নয়, যুবসমাজকে গড়ে তুলতে হবে শুভবোধ জাগ্রত করার মধ্য দিয়ে।
সুকুমারবৃত্তি চর্চার জন্য পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা সহায়ক হয়ে ওঠে। খেলাধুলা, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি ও চিত্রাঙ্কন একজন শিশুর মানসিক বিকাশে ব্যাপক প্রভাব রাখে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতর বেশ কিছু গুণের বিকাশ ঘটে। অপরের দোষ খুঁজে বেড়ানোর চেয়ে সে নিজের দায়িত্ব নিয়ে সচেতন হয়। অপরাধ দেখে সে নীরব থাকে না। কারণ কোনো রকম অন্যায় ও নিষ্ঠুরতায় সে আগ্রহী নয়।
অন্যদিকে বিত্ত, ক্ষমতা, সামাজিক মর্যাদা থাকার পরও শুধু সামাজিক মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচারের অভাবে একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয় না। সামাজিক মূল্যবোধ হলো স্থ্থূলতার পরিবর্তে সূক্ষ্ম রুচির অনুশীলন, আরামের চেয়ে সৌন্দর্য, লাভজনক কর্মকাণ্ডের চেয়ে আনন্দপ্রদ সুকুমারবিদ্যাকে শ্রেষ্ঠ মনে করার ভাবনা। জীবনের সব বিষয়ে বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়ার প্রবণতাও মূল্যবোধের অন্যতম দিক। সমাজে এক শ্রেণির মানুষ আছে, যারা অর্থবিত্তের পূজারি, তাদের বিচারবুদ্ধি স্বার্থের দ্বারা কলঙ্কিত, স্থূল সুখই তাদের কাম্য। পক্ষান্তরে সামাজিক মূল্যবোধ লালনকারী অপরের কল্যাণই বড় বলে মনে করে। এরা আইনকে অবজ্ঞা নয়, মেনে চলে।
সুকুমারবৃত্তি চর্চা ও সামাজিক মূল্যবোধকে অনুশীলন করে মানুষের ভেতর ধর্ষণ ও হত্যাবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করার জন্য সবাই মিলে কাজ করতে হবে। নোংরা মানসিকতা ও অসৎ সঙ্গ যুবসমাজকে বিভ্রান্তির পথে চালিত করলে তা থেকে সঠিক জীবনে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকদের সম্পর্ক আরো ‘নিবিড় ও দৃঢ়’ করার পাশাপাশি তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা আবশ্যক। আমাদের শক্তি আমাদের তারুণ্য। এ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় পাঁচ কোটি তরুণ। দেশের অগ্রগতিতে তাদের অবদান দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। এরা মিথ্যা শক্তিকে যেমন গুঁড়িয়ে দিতে পারে, তেমনি ভূমিকা রাখতে পারে সমাজ-বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ গড়তে। জাতির কাণ্ডারির ভূমিকায় শক্ত হাতে হাল ধরার ক্ষমতাও এদের আছে।
বাংলাদেশে এখন প্রতি তিনজনে দুজনই উপার্জনক্ষম। নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়ায় জাতীয় সঞ্চয় বেড়েছে; অর্থনীতি সবল হয়েছে। বাংলাদেশে এখন ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা পৌনে পাঁচ কোটি। এর সঙ্গে ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী যুব জনসংখ্যাকে ধরলে বলা যায় যে জনসংখ্যার তিন ভাগের দুই ভাগই টগবগে তরুণ। বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠীর ‘উন্নতি করার’ তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। এটা একটা সামাজিক পুঁজি। তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত ও দক্ষ করে তোলার দায়িত্ব পালন করছে বর্তমান সরকার। এখন দরকার অপরাধের জগৎ থেকে তাদের রক্ষা করা।
জঙ্গিবাদ ও মাদকাসক্তি থেকে যুবসমাজকে যেমন রক্ষা করা গেছে, তেমনি এখন দরকার সামাজিক অবক্ষয়ের নোংরা জগৎ থেকে তাদের রক্ষা করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তরুণসমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার জন্য অনুপ্রেরণা দিতে হবে। দেশে বর্তমানে ৪৭ শতাংশ শিক্ষিত বেকার রয়েছে এবং দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ায় চাহিদা মোতাবেক সুষ্ঠু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না। পশ্চিমা বিশ্বে যেখানে প্রতিবছর নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে চাকরি খুঁজতে তরুণদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। বেকার সমস্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্থ-সামাজিক টানাপড়েন সৃষ্টি হচ্ছে। সন্ত্রাস, হত্যা ও রাহাজানি বাড়ার সঙ্গে বেকারদের সংশ্লিষ্টতা আবিষ্কার করেছেন গবেষকরা। অপরাধী গোষ্ঠীর টার্গেটে পরিণত হয়েছে এসব বেকার, কিন্তু শিক্ষিত যুবসমাজ। যুবসমাজকে অপরাধীদের খপ্পর থেকে রক্ষার জন্য জাতীয় পর্যায় থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
সুকুমারবৃত্তি চর্চার পাশাপাশি জাতীয় পাঠ্যক্রম তৈরির সময় সামাজিক অপরাধ ও অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে পঠন-পাঠন বাধ্যতামূলক করা দরকার। ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরিতে ইমাম ও আলেমদের নিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করতে পারে। অপরাধের ব্যাপকতা বৃদ্ধির কারণে আমাদের সমাজ আজ নানাভাবে হুমকির সম্মুখীন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ এককভাবে কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত সহযোগিতা, যা বাংলাদেশে করে দেখাতে পারে।
সুকুমারবৃত্তি চর্চার অন্যতম দিক হলো—অপরের সুবিধা-অসুবিধা, মতামত ও অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা শিশুকাল থেকে অভ্যাস করতে হয়। অন্যের অপরাধ ও সহিংসতা দেখার মাধ্যমে শিশুর মনে সহিংসতার ছাপ বসে যায়। অনেকে অনুকরণ করে শিখে থাকে সহিংসতা। অনেকে অপরাধীকে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে দেখে। সতর্ক থাকতে হবে, সমাজে সহিংস ব্যক্তিরা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে পুরস্কৃত যেন না হয়। অসততার দৃষ্টান্ত কিংবা মারপিট ও খুনাখুনির দৃশ্য শিশুর ভেতর অস্থিরতা তৈরি করে বিপথে চালিত করতে পারে। উদ্ধত ও অবিনীত কিংবা অমার্জিত আচরণে মানুষ বেদনাহত হয়। ভালো আচরণের শিক্ষাও অর্জিত হয় সুকুমারবৃত্তি চর্চার মধ্য দিয়ে। পারিবারিক বন্ধন এবং সুকুমারবৃত্তির চর্চাই সামাজিক অবক্ষয় রোধ করে এ দেশকে সুন্দর করতে পারে। সুকুমারবৃত্তি চর্চার কারণে একজন অন্যায়কে সমূলে উৎপাটন করতে উৎসাহী হয় এবং নিষ্ঠুরতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করে।
লেখক : মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখার মূল লিঙ্কঃ দৈনিক কালের কন্ঠ