সুকুমার বৃত্তি চর্চা জরুরি
৮ জুলাই (২০১৯) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জনৈক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘ধর্ষণ যারা করে তারা মানুষ না’। অর্থাৎ মানুষ হবার জন্য যেসব গুণাবলি থাকা দরকার তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, সামাজিক মূল্যবোধ লালন করা, মানবতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য রক্ষা করে জীবিকানির্বাহ করা। কিন্তু এ সমাজে পাশবিকতা আছে, আছে অপরের ক্ষতি করে নিজে সুখী হওয়ার প্রচেষ্টা। আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। এজন্য ধর্ষণ রোধে পুরুষ সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পুরুষ সমাজকেও বলব, ধর্ষণটা তো পুরুষ সমাজ করে যাচ্ছে, পুরুষ সমাজেরও একটা আওয়াজ তোলা উচিত। খালি নারীরাই চিত্কার করে যাবে নাকি? ’ সংবাদপত্রের সূত্র অনুসারে, ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে দুই হাজারের বেশি নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩১ জন। যাদের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৬ জনকে। গতবছর ১২ মাসে যে পরিমাণ ধর্ষণ হয়েছে তার অর্ধেক সময়ে এ বছর ধর্ষণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ।
আসলে পাশবিকতার প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দরকার শিশুকাল থেকে সুকুমার বৃত্তির চর্চা করা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কেবল নয় মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা ও হাট-বাজারের নিরক্ষর মানুষকে সত্ প্রবৃত্তির প্রতি অনুরাগী করে তুলতে হবে, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর জন্য প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে, অপরাধ করলে তার শাস্তি দ্রুত কার্যকর করার দৃষ্টান্তও তুলে ধরতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে- এ ধরনের অভিযোগ এখন অমূলক এটাও প্রমাণ করতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই। তবে শেষ পর্যন্ত সকলে স্বীকার করেন যে, সমাজের বিবেক জাগ্রত করা দরকার। যে তরুণসমাজ আজ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে তাদের তারুণ্যের শক্তিকে ভালো কাজে লাগানোর জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর জোর দিতে হবে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানের ঘটনার পর আমরা শিক্ষিত যুবসমাজের দিকে মনোযোগ দিয়ে জঙ্গিবাদের ভূত থেকে তাদের রক্ষা করেছি। এখন প্রয়োজন আরো একটি যুদ্ধ- সামাজিক অবক্ষয় রোধে নারী-পুরুষ সকলকে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হওয়া।
সুকুমার বৃত্তি চর্চার প্রধান ক্ষেত্র হলো পারিবারিক জীবন। নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে আমাদের। তাদের মনের কথাটা শোনার চেষ্টা করা দরকার। তাদের কী চাহিদা সেটা জানা, তাদেরকে আরো কাছে টেনে নেওয়া, তাদের ভালো-মন্দ, সমস্যা দেখা, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা যেন বাবা-মায়ের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারে সে সুযোগটা তাদের দেওয়া খুব প্রয়োজন। সন্তানেরা কীভাবে চলছে, কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে-সেদিকে ‘বিশেষভাবে দৃষ্টি’ দেওয়ার জন্য অভিভাবকদের মনোযোগী হতে হবে। সুকুমার বৃত্তি চর্চা ও সামাজিক মূল্যবোধকে অনুশীলন করে মানুষের ভেতর ধর্ষণ ও হত্যাবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করার জন্য সবাই মিলে কাজ করতে হবে। নোংরা মানসিকতা ও অসত্ সঙ্গ যুবসমাজকে বিভ্রান্তির পথে চালিত করলে তা থেকে সঠিক জীবনে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকদের সম্পর্ক আরো ‘নিবিড় ও দৃঢ়’ করার পাশাপাশি তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা আবশ্যক। আমাদের শক্তি আমাদের তারুণ্য। এ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ অর্থাত্ প্রায় ৫ কোটি তরুণ। দেশের অগ্রগতিতে তাদের অবদান দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। এরা মিথ্যা শক্তিকে যেমন গুঁড়িয়ে দিতে পারে তেমনি ভূমিকা রাখতে পারে সমাজ-বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ গড়তে। জাতির কাণ্ডারির ভূমিকায় শক্ত হাতে হাল ধরার ক্ষমতাও এদের আছে। কোনো অন্যায় কিংবা মিথ্যা শক্তির কাছে এরা কখনো মাথা নত করেনি আর করবেও না কোনোদিন। বাংলাদেশে এখন প্রতি তিনজনে দুজনই উপার্জনক্ষম। নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়ায় জাতীয় সঞ্চয় বেড়েছে; অর্থনীতি সবল হয়েছে। এখন ১০ থেকে ২৪ বছর বয়েসি তরুণের সংখ্যা পৌনে পাঁচ কোটি। এর সঙ্গে ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়েসি যুব জনসংখ্যাকে ধরলে বলা যায় যে জনসংখ্যার তিন ভাগের দুভাগই টগবগে তরুণ। বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠীর ‘উন্নতি করার’ তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। এটা একটা সামাজিক পুঁজি। তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত ও দক্ষ করে তোলার দায়িত্ব পালন করছে বর্তমান সরকার। এখন দরকার অপরাধের জগত্ থেকে তাদের রক্ষা করা। কারণ দেশের এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। সামাজিক অবক্ষয়ের ব্যাপক বিস্তারের কারণে নানাবিধ অপকর্মে জড়িত হচ্ছে তারা। কে তাদের রক্ষা করবে? সমাজের ভেতর-বাইরে তারা দেখছে ক্ষমতাবানদের দাপট ও যথেচ্ছাচার। অপরাধ করেও রক্ষা পাচ্ছে কেউ কেউ। ফলে সমাজের আনাচে-কানাচে শক্ত আস্তানা গেড়েছে তারা। সেখানকার প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় তরুণরা সমাজের ভেতর দুর্বল মানুষ ও নারীদের নিগৃহীত করার সুযোগ নিচ্ছে।
সুকুমার বৃত্তি চর্চার অন্যতম দিক হলো—অপরের সুবিধা-অসুবিধা, মতামত ও অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন শিশুকাল থেকে অভ্যাস করাতে হয়। অন্যের অপরাধ ও সহিংসতা দেখার মাধ্যমে শিশুর মনে সহিংসতার ছাপ বসে যায়। অনেকে অনুকরণ করে শিখে থাকে সহিংসতা। অনেকে অপরাধীকে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে দেখে। সতর্ক থাকতে হবে, সমাজে সহিংস ব্যক্তিরা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে পুরস্কৃত যেন না হয়। এই অভিজ্ঞতা শিশুকাল থেকে সন্তানের মনে সহিংসতার বীজ রোপণ করে দিতে পারে; উপরন্তু ভীতি সঞ্চার করতে পারে। অসততার দৃষ্টান্ত কিংবা মারপিট ও খুনাখুনির দৃশ্য তার ভেতর অস্থিরতা তৈরি করে বিপথে চালিত করতে পারে। উদ্ধত ও অবিনীত কিংবা অমার্জিত আচরণে মানুষ বেদনাহত হয়। ভালো আচরণের শিক্ষাও অর্জিত হয় সুকুমার বৃত্তি চর্চার মধ্য দিয়ে। ভালো মানুষ বুঝতে পারে, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষের জীবনের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিধানের অধিকার রয়েছে। অপরাধী কর্তৃক কাউকে নৃশংস অত্যাচার ও খুন করা স্পষ্টত মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত পর্যায়। তাদের নির্মূল করা এবং যুবসমাজকে বাঁচাতে যা করণীয় তার সবই করতে হবে সরকার ও সচেতন জনগণকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও পারিবারিক বন্ধন এবং সুকুমার বৃত্তির চর্চাই সামাজিক অবক্ষয় রোধ করে এ দেশকে সুন্দর করতে পারে। সুকুমার বৃত্তি চর্চার কারণে একজন অন্যায়কে সমূলে উত্পাটন করতে উত্সাহী হয় এবং নিষ্ঠুরতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। মূলত শিক্ষাকে সত্ আর ন্যায়ের পথে কাজে লাগানো এবং নিজ স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে, অযৌক্তিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্রতী হওয়াই সুকুমার বৃত্তি চর্চার অন্যতম দিক।
লেখক: মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
লেখার মূল লিঙ্কঃ দৈনিক ইত্তেফাক