রাজনৈতিক ডিসকোর্সে ভিন্নমতের সংযোজন
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজের নানাবিধ চাহিদার প্রেক্ষাপটে চলমান রাজনীতিতে প্রতিনিয়তই ঘটছে নতুন সংযোজন ও বিয়োজন। একুশ শতাব্দীর তথ্যপ্রযুক্তি, বিশ্বায়ন ও কর্পোরেট পুঁজির বাস্তবতায় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা অনেক কিছুরই কার্যকারিতা, গ্রহণযোগ্যতা, আবেদন কিংবা প্রভাব শেষ হয়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এ পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক ডিসকোর্সে এক অভিনব সংযোজন অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের ‘উত্তরগণতন্ত্র ও লিংকনের পিপল’ গ্রন্থটি। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত বইটিতে লেখক অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান তাঁর ভিন্নমত, চিন্তা-চেতনা, ধ্যানধারণা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে উপস্থাপন করেছেন। লেখক বইটি উত্সর্গ করেছেন সত্ ও আদর্শবান রাজনীতিক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। বইটি ইতোমধ্যে পাঠকসমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বাংলাদেশে মার্কেটিং-এর ফিলিপ কটলারখ্যাত এবং টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়ার জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ড. মীজানুর রহমান দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বৈশ্বিক বাণিজ্য ও বাজার ব্যবস্থাপনাসহ সমসাময়িক নানা বিষয় গভীর মনোযোগের সাথে একনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ ও চিন্তা করছেন। সমাজে প্রচলিত মান্ধাতা আমলের গতানুগতিক ধ্যানধারণা, পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান পাঠক সম্মুখে অবতারণা করেছেন সময়োপযোগী নতুন জ্ঞান, মতামত ও চিন্তা-চেতনা, দিকনিদের্শনা এবং দেখাচ্ছেন সঠিক মানানসই পথ ও পাথেয়। গণমাধ্যম তাঁর এই সব ভিন্ন অভিব্যক্তি গুরুত্বের সাথে পাঠকের নজরে আনছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় টকশোসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান সমসাময়িক নানা ইস্যুতে নিজস্ব মতামত প্রকাশের মাধ্যমে সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অগ্রগতির সোপানে উপনীত করার লক্ষ্যে নির্ভীক ও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাঁর কলাম আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। বাস্তবতা এবং যুক্তির আলোকে অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের অবস্থান সর্বদা সত্য, সুন্দর, মঙ্গল ও কল্যাণের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, প্রগতিশীল ভাবনা উপস্থাপনে তিনি সর্বদা সচেষ্ট। নিজস্ব মতামত, বিশিষ্ট যুক্তি এবং বক্তব্য উপস্থাপনে তিনি নির্ভীক। ‘উত্তরগণতন্ত্র ও লিংকনের পিপল’ গ্রন্থে মোট ৩০টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত নির্বাচিত প্রবন্ধগুলো গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। বইটির প্রথম প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় পোস্ট ডেমোক্রেসি বা উত্তরগণতন্ত্র নামে এক অভিনব ডিসকোর্স পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন আব্রাহাম লিংকন-এর গণতন্ত্রের সেই বিখ্যাত সংজ্ঞা এবং ‘পিপল’ বা জনগণ এখন বদলে গেছে। গণতন্ত্র চর্চার হাতিয়ার বদলে গেছে, প্রযুক্তির ধাক্কায় পুরনো গণমাধ্যম মৃতপ্রায়, যেগুলোকে একসময় গণতন্ত্রের স্তম্ভ হিসেবে গণ্য করা হতো। উত্তরগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামগ্রিক নির্বাচন ব্যবস্থাও তিনি তুলে ধরেছেন। বইটির নামকরণ করা হয়েছে উক্ত প্রবন্ধ থেকেই। গণতন্ত্রের অন্যতম সোপান হচ্ছে নির্বাচন। সদ্য সমাপ্ত হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচন নিয়ে পুরো জাতি বেশ ব্যস্ত সময় পার করেছে। এ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে? নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের এবং নেতাকর্মীদের দায়-দায়িত্ব, ভূমিকা সম্পর্কে লেখক গঠনমূলক বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
বিশ্বায়ন এবং তথ্য-প্রযুক্তির যুগে মানসম্মত এবং যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য লেখক তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের আলোকে অনেক বিষয়ের সংযোজন ঘটিয়েছেন বইটিতে। ‘শিক্ষা পণ্যের বিশ্বায়ন’, ‘সময়োপযোগী শিক্ষা :সংকট ও সম্ভাবনা’ ইত্যাদি শিরোনামে প্রবন্ধগুলো শিক্ষাব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে ভরপুর। যেগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে অভিনব রূপ দেখাচ্ছে। কিছুদিন আগেই আমরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে বড় ধরনের আন্দোলন লক্ষ করেছি। অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এই আন্দোলকে শক্তিশালী ব্যর্থ আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করেছেন। কারণ এই আন্দোলনের কার্যকারিতা কয়েকদিনের মধ্যে শেষ হয়েছে। যে মা সন্তানের নিরাপত্তার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন সেই মা এখন সন্তানকে নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে রাস্তা পার হচ্ছেন। অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান মূলত মাকের্টিং-এর অধ্যাপক। নতুন বাস্তবতায় মাকেটিং-এর নানা দিকসমূহ তিনি উপস্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘যেভাবেই হোক রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনতেই হবে। এজন্য রাজনীতিতে মেধাবী লোকদের বিকল্প নেই। কেননা রাজনীতিবিদরাই সমাজের নানা সমস্যা নিশ্চিত করবেন এবং সেগুলোর সুষ্ঠু সমাধান করার জন্য নেতৃত্ব দিবেন। মানুষকে সঠিক পথ দেখাতে দিকনির্দেশনা দিবেন। কাজেই সেই রাজনীতিবিদদের অবশ্যই মেধাবী হতে হবে। যারা লেখাপড়ায় দুর্বল, কোনোমতে তৃতীয় শ্রেণিতে পাস করেছে, শিক্ষাজীবনে তেমন কোনো অর্জন নেই, তারা কীভাবে রাজনীতি করবেন? এমন ব্যক্তি সমাজের মানুষের সমস্যা কীভাবে চিহ্নিত করে সেগুলো সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে সমাধান দেখাবেন? একারণে আমি মনে করি, রাজনীতিতে সততার চাইতে মেধার গুরুত্ব বেশি। এ লক্ষ্যে রাজনীতিতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মেধা কোটা চালু হওয়া উচিত।’ অপরাজনীতির বিরুদ্ধেও তিনি কলম ধরেছেন। বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে লেখক ব্যক্ত করেছেন, ‘প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার বিরুদ্ধে যত শক্তি আছে, তাদের মূল লক্ষ্যই ছিল ভারতবিরোধিতা, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি এবং ধর্মান্ধতা। প্রত্যকটি নির্বাচনে তারা এগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ও উস্কে দেয়। ঐক্যফ্রন্ট, বিএনপি এবং জামায়াতকে সেই পুরোনো ধাঁচের কথাবার্তাই বলতে হবে। তা হলো ভারতবিরোধিতা, ধর্ম চলে যাওয়া, ধর্মাশ্রয়ী বক্তব্য। কারণ এগুলোই তাদের রাজনীতির মূলধন।’ তাঁর ভাষা শাণিত, সহজবোধ্য এবং যুক্তি বিন্যাসে দৃষ্টান্ত ব্যবহারে তিনি দক্ষ। তিনি পাঠক সমাজকে সহজেই কাছে টানেন তাঁর ভিন্নমতের যুক্তি দিয়ে। যে ভিন্নমত আমাদের বিষয় বোধগম্যতায় সহায়তা করে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও প্রসার প্রত্যাশা করছি। সেই সাথে বর্তমান সমাজবাস্তবতায় তাঁর ভিন্নধর্মী চিন্তা-চেতনা এবং ধ্যানধারণা প্রয়োগ কাম্য। তবেই এগিয়ে যাবে সমাজ, সমাধান হবে নানাবিধ সমস্যার।
উত্তরগণতন্ত্র ও লিংকনের পিপল
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
প্রচ্ছদ :অনন্ত আকাশ
মেরিট ফেয়ার প্রকাশন
দাম : ২৫০ টাকা